বাংলায় লেখা ‘ভার্চ্যুয়াল ট্যুর’। মাউসের এক ক্লিকেই শুরু হলো ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) ভ্রমণ। এল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিস্তম্ভ। চেনা স্মৃতিস্তম্ভের অবস্থান ধানমন্ডির পুরোনো ৩২ নম্বর সড়কের পাশে। যার পেছনে ধানমন্ডি লেক। বৃক্ষশোভিত প্রকৃতি। মাউস নাড়িয়ে ঘুরে দেখি স্মৃতিস্তম্ভ চত্বর। তখনই দৃষ্টি কাড়ে পর্দার ‘সাউন্ড’ সংকেতটি। সেখানে চাপ দিতেই নারীকণ্ঠ ভেসে আসে। প্রাঞ্জল বাংলায় সে কণ্ঠ জানায়, স্মৃতিস্তম্ভটির অবস্থান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের সম্মুখে। জাতীয় দিবসসহ বিভিন্ন সময় যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আসেন।
আমরা এগিয়ে যাই পরের ধাপে। ধাপ বলতে আরেকটি ৩৬০ ডিগ্রি ছবিতে। এই ছবিতে দেখা যায় জাদুঘর চত্বরের দেয়াল ঘেঁষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতিকে ভিত্তি ধরে মাউসের ইশারায় ঘুরে দেখা যায় জাদুঘরের বিক্রয়কেন্দ্র, এমনকি টিকিটঘরটিও।
পরের ছবিতেই প্রবেশপথ পেরিয়ে আঙিনাসমেত ঐতিহাসিক বাড়িটি। যে বাড়ি শুধু ইট, সিমেন্ট, বালুর ইমারত নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশও। ‘আই’ নামের তথ্যসংকতেটি জানান দেয়, জাদুঘরের মূল ভবনের নাম ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’। পাশেই জুড়ে দেওয়া আছে এই বাড়ির ইতিহাসের ধারাবর্ণনা।
সে ইতিহাসের পথে হেঁটেই চাপ দিই পরের ছবিতে। গাড়িবারান্দা থেকে প্রবেশ করি ভবনের নিচতলায়। করিডর পেরিয়ে অফিসঘর। সুসজ্জিত আসবাবের বদলে তথ্যসংকেতটি আগ্রহী করে তোলে। যেখানে লেখা ‘গুলির চিহ্ন’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে এই অফিসঘরে এসে পড়ে যান, ঘাতকেরা আবারও গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। ছবিটি ঘোরালে তথ্যনির্দেশক চিহ্নটি আবারও জানায়, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরকেও গুলি করে হত্যার নির্মমতার কথা।
ভার্চ্যুয়াল ভ্রমণের প্রাণহীন ছবিগুলো কথা বলে ওঠে যেন। সে কথায় মিশে থাকে শোক আর নির্মমতা। ভবনের পরতে পরতে ঘাতকের বুলেটের ক্ষতচিহ্ন, রক্তের দাগ, সাজিয়ে রাখা বাড়ির বাসিন্দাদের স্মৃতিস্মারক। যা নিয়ে যায় বইয়ের পাতায়, ইতিহাসের অন্দরে। ইতিহাস জানি বলে বেদনাহত হতে হয়। তবু নিবিড়ভাবে জাদুঘর দর্শনের সুযোগ পেয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার, বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ, দ্বিতীয় তলার বসার ঘর, ভবনের মূল সিঁড়ি।
সে সিঁড়ি দেখে আনমনে কবি নির্মলেন্দু গুণকে আউড়াই, ‘...তোমার নিষ্প্রাণ দেহখানি সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে, গড়াতে, গড়াতে/ আমাদের পায়ের তলায় এসে হুমড়ি খেয়ে থামল।/ কিন্তু তোমার রক্তস্রোত থামল না।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল এই সিঁড়িতেই। ফুলের পাপড়ি ছিটানো সিঁড়ির দেয়ালে গর্বের লাল-সবুজ পতাকা ঝোলানো, সামনে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের আঁকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।
এভাবে ৪০টি ছবিতে সম্পন্ন হয়েছে ভার্চ্যুয়াল ভ্রমণ। তিনতলা ভবন ঘুরে ভ্রমণ শেষ হয়েছে আবার বাড়ির নিচতলায় এসে। যেখানে আছে বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলের দোলনা, চৌবাচ্চা, সবুজ প্রাঙ্গণ।
গাইডের মতো পুরো ভ্রমণে সহায়তা করল মনিটরের নিচের দিকে থাকা একসারি সাংকেতিক চিহ্ন, যেগুলো নির্দেশ করে ভার্চ্যুয়াল ভ্রমণে সামনে–পেছনে যাওয়া, একেকটি ছবি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘুরে দেখা, ছবি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা, পর্দাজুড়ে দেখার ব্যবস্থা, ভার্চ্যুয়াল ট্যুর নিয়ে মন্তব্যের ঘর।
অনলাইনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ভ্রমণ করা যাবে
tour.bangabandhumuseum.org.bd ঠিকানার ওয়েবসাইটে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের টানে
ভার্চ্যুয়াল ভ্রমণের কাজটি করেছেন তরুণ দম্পতি নাসির খান ও মুন রহমান। নাসির খান পেশায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী। মুন রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে পড়াশোনা শেষে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের ‘ভার্চ্যুয়াল ট্যুর’ নির্মাণ শুরু করেছিলেন দুজন। হস্তান্তর করেছেন এ বছরের জানুয়ারি মাসে। নাসির খান বলেন, ‘অনেক জায়গায় আমরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সময়-সুযোগের অভাবে যেতে পারি না, কিন্তু যাওয়া উচিত। আমরা চেয়েছিলাম সেগুলো মানুষের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিতে। সে ধারণা থেকেই ভার্চ্যুয়াল ট্যুর তৈরির জন্য দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনার তালিকা করি।’
কাকতালীয়ভাবে তাঁরা যখন ভার্চ্যুয়াল ট্যুরের কথা ভাবছেন, সেটা আগস্ট মাস। ২০১৭ সালের সেই শোকের মাসে নাসির ও মুন ভাবলেন প্রথম কাজটি তাঁরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর নিয়েই শুরু করবেন। কিন্তু চাইলেই তো আর সম্ভব নয়!
যোগাযোগ করলেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। অনুমতি মিললে আটঘাট বেঁধে নামলেন কাজের পরিকল্পনায়। পড়াশোনা করলেন ৩২ নম্বরের বাড়ির ওপর। দর্শনার্থী হিসেবে পরিদর্শন করলেন জাদুঘর। নাসির খান বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম মানুষ যেভাবে ভবনে প্রবেশ করে বেরিয়ে আসে, সেভাবেই ঘুরে দেখাতে।’
মানসম্পন্ন ক্যামেরা জোগাড় করা হলো। নিজেদের রোজকার কাজের ফাঁকে তাঁরা হাজির হতেন জাদুঘরে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ছবি তোলাসহ ভার্চ্যুয়াল ট্যুরের কারিগরি কাজ করেন দুজন। নাসির বলছিলেন, ‘নিজেদের আগ্রহে কাজটি আমরা করছিলাম, তাই বেশি সময় দিচ্ছিলাম। তথ্য ও ছবি ব্যবহারে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও পরামর্শের ব্যাপারও ছিল।’
নাসির খান ও মুন রহমানের উদ্যোগ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, তাঁরা দুজনে ব্যক্তিগত আগ্রহ, শ্রম ও আন্তরিকতায় কাজটি করেছে। আমাদের তরুণেরা যে ভালো কিছু করতে পারে এই ভার্চ্যুয়াল ট্যুর তা মনে করিয়ে দেয়। কোভিড-১৯–এর দুঃসময়ে তো বটেই, যাঁরা সশরীর জাদুঘরে আসতে পারেন না, তাঁরাও ভার্চ্যুয়াল ট্যুরের মাধ্যমে জাদুঘরটি দেখার সুযোগ পাবেন।
প্রথম প্রকাশ: প্রথম আলো, ৮ আগস্ট ২০২০, https://www.prothomalo.com/life/%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%81-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%98%E0%A6%B0-%E0%A6%AD%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A6%A3