ছোটদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং

নাসির খান সৈকত , মোশারফ হোসেন টিপু , নিয়াজ মাসুদ রাহাত , মুনির হাসান (সম্পাদক)

স্ক্র্যাচ একটি ব্লক ভিত্তিক প্রোগ্রামিং ভাষা হিসেবে পরিচিত হলেও যৌক্তিক চিন্তার বিকাশ এবং ক্রিয়েটিভ লার্নিং-এর অন্যতম কার্যকরি সরঞ্জাম। প্রোগ্রামিং শিখে সবসময় কম্পিউটার বিজ্ঞানী হতে হবে এমন না। প্রোগ্রামিং হল কম্পিউটারকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার পদ্ধতি। কম্পিউটার বড় সমস্যা বা কাজ ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে এবং সেই ছোট ছোট কাজগুলো ধাপে ধাপে সমাধানের মাধ্যমেই বড় কাজটি সম্পন্ন করা হয়ে যায়।

যে কোন একটি কাজ প্রোগ্রাম লিখে সমাধান করার জন্য কিভাবে চিন্তা করতে হবে এবং স্ক্র্যাচ ব্যবহার করে কিভাবে তা সমাধান করা যাবে তা নিয়ে এই বইতে আলোচনা করা হয়েছে। একটি প্রোগ্রামিং সমস্যা একাধিক পদ্ধতিতে সমাধানের উদাহারণ দেখানো হয়েছে। এছাড়াও স্ক্র্যাচ ব্যবহার করে বিভিন্ন এনিমেশন গল্প এবং গেম তৈরীর উদাহারণ দেখানো হয়েছে।

ছোটদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং

ভূমিকা

মুনির হাসার তার টিমকে নিয়ে আবার একটি অসাধারণ কাজ করেছে। তারা শুধু যে স্ক্র্যাচ নামে সারা পৃথিবীর শিশু কিশোরদের প্রোগ্রামিং প্ল্যাটফর্মটিকে বাংলায় অনুবাদ করেছে তা নয় সেটি ব্যবহার করার জন্য এই চমৎকার ম্যানুয়েলটি তৈরি করেছে। এখন এই দেশের যে কোন শিশু চাইলেই তার নিজের মাতৃভাষায় স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং করতে পারবে এবং তার সাহায্যের জন্যে হাতের পাশে থাকবে এই ম্যানুয়েল।

প্রোগ্রামিং কথাটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে একটি দৃশ্য ফুটে ওঠে, যেখানে এলোমেলো চুল এবং খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে প্রোগ্রামাররা উবু হয়ে কম্পিউটার মনিটরের সামনে গভীর মনোযোগ নিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে কীবোর্ডে ঝড় তুলে দুর্বোধ্য সাংকেতিক চিহ্ন লিখে যাচ্ছে। কিন্তু ছোট শিশু কিশোররাও যে একবারে একশ ভাগ খেলার কৌশলে ছোট ছোট ব্লক একটার পাশে একটা বসিয়ে একবারে সত্যিকারের প্রোগ্রামিং করতে পারে সেটি নিশ্চয়ই আমরা আগে কখনো কল্পনা করিনি। কিন্তু স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিংয়ে হুবহু এই ব্যাপারটি ঘটছে। প্রোগ্রামিং ব্যাপারটির মূল বিষয়টি যেহেতু যুক্তি ব্যবহার আর সিদ্ধান্ত নেওয়া- তাই সেটি করার জন্য লিখিত ভাষা ব্যবহার না করেও শুধুমাত্র কিছু ছবি ব্যবহার করেই করা সম্ভব। স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিংয়ে সেটি করে দেখানো হয়েছে । এবং সে কারনেই সম্ভবত সারা পৃথিবীতে ছেলে বুড়ো সবার মাঝে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি প্রোগ্রামিং প্ল্যাটফর্ম।

আমাদের দেশের শিশুদের জীবনকে আনন্দদায়ক এবং অর্থপূর্ন করার দায়িত্ব আমাদের, আমরা সব সময় যে সেটা করতে পেরেছি তা নয়। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের দীর্ঘদিন মুখস্ত নির্ভর, পরীক্ষা নির্ভর নিরানন্দ একটা পরিবেশের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তাদের ভেতর কতো রকম সৃজনশীল প্রতিভা কিন্তু আমরা সেটি মুক্ত হতে দিই না । তাদের যখন আনন্দ করার কথা তখন তারা কোচিং সেন্টারের বন্ধ ঘরে পরীক্ষা দেওয়ার কৌশল শিখেছে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পদ্ধতিতে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে সেটার বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করে আছি। সেই পরিবর্তন গুলোর একটি হচ্ছে একেবারে খুবই প্রাথমিক শ্রেণীগুলোতে শিশুদের স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিংয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এই সৌভাগ্যবান শিশুরা কতো দ্রুত এই স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিংয়ের অবিশ্বাস্য সৃজনশীলতার আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করবে আমরা সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। এই শিশুদের সবাই বড় হয়ে প্রোগ্রামার হবে সেটি মোটেও আমাদের উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু সবাই যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেটি আমাদের স্বপ্ন।

আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা পাঁচ কোটির মত, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের জনসংখ্যা এর চাইতে কম। দুর্ভাগ্য ক্রমে শিক্ষার পিছনে অর্থব্যয় দিন দিন কমে আসছে।তাই দেশের সব স্কুলে সব ধরনের শিক্ষা উপকরণ বা কম্পিউটার ল্যাব সমান ভাবে পাওয়া যাবে সেটা আশা করি না। কিন্তু যেহেতু স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং শেখার জন্য আকাশ ছোঁয়া রিসোর্সের প্রয়োজন নেই, একটি কম্পিউটার ই যথেষ্ট এমন কী কম্পিউটার না থাকলে স্মার্টফোন দিয়েও শেখা সম্ভব তাই আমরা আশা করছি একেবারে প্রত্যন্ত এলাকার একজন হত দরিদ্র পরিবারের সন্তানও যেন এই চমৎকার সুযোগটি গ্রহণ করতে পারবে। “এই দেশের প্রাথমিক স্কুলের প্রত্যেকটি শিশুও প্রোগ্রামিং করতে পারে”- এই ধরনের একটি দুঃসাহসী বাক্য উচ্চারণ করার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি।

মনে আছে, আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে এম.আই.টি এর মিডিয়া ল্যাবে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সেখানকার অসংখ্য চোখ ধাধানো আবিষ্কারের পাশাপাশি আমি তাদের উদ্ভাবিত স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিংয়ের প্ল্যাটফর্মটি প্রথম সেখানে দেখেছিলাম। শিশু কিশোরদের জন্য কিন্তু সত্যিকারের প্রোগ্রামিং করার উপযোগী এই প্ল্যাটফর্মটি দেখে সেদিন আমি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম পৃথিবীর সম্পদশালী দেশের শিশুরা কতো সৌভাগ্যবান তারা কতো অল্পবয়সে কতো অসাধারণ সৃষ্টিশীল কাজ করার সুযোগ পায়। নিজের দেশের শিশুদের কথা ভেবে এক ধরনের বেদনা অনুভব করেছিলাম !

আমার মনে এখন আর সেই বেদনা নেই, আমি জানি আমাদের দেশের প্রতিটি শিশুও এই চমৎকার সুযোগটি পেতে যাচ্ছে। “এই দেশের প্রত্যেকটি শিশু প্রোগ্রামিং জানে” বাক্যটি দুঃসাহসী নয়, খুবই স্বাভাবিক একটি বাক্য হবে, আমি সে ব্যাপারে খুবই আশাবাদী ।

অবশেষে যারা এই বইটি লিখেছে ,নাসির খান সৈকত, মোশারফ হোসেন টিপু, নিয়াজ মাসুদ রাহাত এবং মুনির হাসান, যে এই বইটি সম্পাদনা করেছে তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। ভবিষ্যতে তারা নতুন কী জাদু নিয়ে আসবে সেটি দেখার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।

 

মুহাম্মদ জাফর ইকবাল
আগস্ট, ২০২২